বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে এক বাংলাদেশিকে। জিয়াদ নামে ওই ব্যক্তিকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগা থেকে আটক করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি’র কর্মকর্তারা। জিয়াদই আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও এমপি আনারের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের সহযোগী বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার ২৩ বছর বয়সী জিয়াদকে আটক করা হয়। আটকের সময় জিহাদের পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি এবং খয়েরি রঙের প্যান্ট। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই এমপি আনারের লাশ উদ্ধার করতে চান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর তিনি মধ্য কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন বলে জানা গেছে। কিন্তু বুধবার খুনের ঘটনার সামনে আসার পরেই বনগা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
সিআইডি সূত্রে খবর, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডকে সফল করতেই অবৈধভাবে ভারতে এসেছিল এই জিয়াদ। গত ৩০ এপ্রিল ভারতে প্রবেশের পর তিনি মুম্বাই চলে যান। কিন্তু এমপি আনার যখন গত ১২ মে কলকাতার বরানগরের মন্ডলপাড়ায় পূর্ব পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন, তার আগেই জিয়াদ ফের মুম্বাই থেকে কলকাতায় চলে আসেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ১৩ মে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটেই শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে।জিয়াদের দায়িত্ব ছিল ওই লাশের টুকরোকে বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে দেওয়ার। কারণ ওই আবাসনের নির্দিষ্ট ফ্ল্যাট থেকে বেশকিছু প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া গেছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান ওই ব্যাগ গুলোতে করেই দেহাংশ ভরে তা লাগেজে করে বাইরে ফেলা হয়েছে।পাশাপাশি ওই একই ঘটনায় জুবের নামে ক্যাব চালককেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা।ইতিমধ্যেই তার গাড়িটিকেও জব্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে আটক করা হয়েছে সাদা রঙের ওই মারুতি গাড়িটিকে। জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল অনলাইন রেন্টালের মাধ্যমে সেই গাড়ি ভাড়া করে আততায়ীরা। গত ১২ মে ভারতে আসে সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার। তিনি ওঠেন বরানগরের পূর্ব পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরদিন ১৩ মে চিকিৎসা করাতে যাবেন বলে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন সাংসদ। কিন্তু ওইদিন রাতেই নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বহুতল আবাসনে তাকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। পরে ওই সাদা রঙের ক্যাব গাড়ি করে প্রথম পর্যায়ে আজিম আনারের লাশের অংশ ফ্ল্যাট থেকে বের করা হয় একটি সুটকেসের মধ্যে করে।জিজ্ঞাসাবাদে ওই সাদা গাড়ির চালক জানিয়েছে, ১৪ মে এক নারী ও দুই ব্যক্তিকে সুটকেস সহ অ্যাক্সিস শপিং মলের সামনে নামায়। অন্যদিকে সিআইডি সিসিভিটি ফুটেজ দেখে জানতে পেরেছে অ্যাক্সিস শপিং মলে নামানোর আগে নজরুল তীর্থর কাছে গাড়িটি ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময় দেহাংশ কোথায় ফেলা হবে সেই নিয়েই মিটিং হয় গাড়ির মধ্যে। তাদের সেই আলো আলোচনা শুনতে পারেন গাড়ি চালক। এমনটাই জানতে পরে সিআইডি কর্মকর্তারা। এরপর তাদের অ্যাক্সিস শপিং মলের সামনে নামিয়ে দেয় চালক। ফলে সিআইডি মনে করে চালক অনেক কিছুই জানে যা সে বলছে না। তদন্তের স্বার্থে ওই চালককে আটক করেছে পুলিশ।ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সাংসদের খুনের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় নিউটাউন থানায় একটি খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে এই ঘটনায় ব্যবহৃত আরও একটি গাড়িকে জব্দ করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় নিউটাউন থানার সামনে এনে গাড়ির ভেতর থেকে আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিক টিম। জানা গেছে গাড়ির মালিক তার গাড়িটি ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিল। গাড়ির মালিককে নিউটাউন থানার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ইতিমধ্যেই এই মামলার তদন্তের ভার হাতে নিয়েছে সিআইডি। আর তদন্তে নেমে নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে গোয়েন্দাদের হাতে। এমপি আনারকে নির্মমভাবে হত্যার নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের বিপুল অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশী আক্তারুজ্জামান শাহীন নিজেও একজন স্বর্ণ চোরাচালানকারী। এমপি আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধেও স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। কলকাতায় শাহীন ও আজিমের যৌথ ব্যবসাও রয়েছে বলে জানা যায়। জানা গেছে, এমপি আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশী আক্তারুজ্জামান শাহীন। হত্যাকাণ্ডের আগে তাকে কিছু টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা দেওয়ার কথা ছিল হত্যাকাণ্ডের পর।এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক বন্ধু ও চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমানকে।কলকাতায় বসে হত্যার চূড়ান্ত ছক এঁকে বাংলাদেশে চলে আসে শাহীন। পরে আমানসহ ছয় জন মিলে এমপি আজিমকে প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। পরে লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে ট্রলিব্যাগের মাধ্যমে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ফেলে দেয়।
বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যায়, গত ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান শাহীন আমানুল্লাহ আমান ও সিলিস্তা রহমান নামে নিজের এক বান্ধবীকে নিয়ে কলকাতা যান।সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা।কলকাতায় আরও আগে থেকেই অবস্থান করছিল শাহীনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে।হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যায় কলকাতায়। ফয়সাল আলী শাজী ও মোস্তাফিজুর রহমান নামে দুই ভাড়াটে খুনি কলকাতায় গিয়ে আমানের সঙ্গে যোগ দেয়। কলকাতার ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটে ‘হোটেল প্লাজা’য় একটি ঘর ভাড়া নেয় ফয়সাল আলী সাজি ও মোস্তাফিজুর রহমান। ওই হোটেলের ১২এ রুমে ২ মে থেকে ১৩ মে ছিলেন। হোটেলের রেজিষ্টারেও তার উল্লেখ আছে। এমপি আনার যে ১২ মে কলকাতায় যাবেন তা আগে থেকেই জানতো শাহীন। সেই মতো তাকে হত্যার জন্য তার সঙ্গীদের সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেন শাহীন। গত ১২ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান এমপি আনার। প্রথম দিন তিনি তার পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা ।বিকালের দিকে এমপি আনার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে জিম্মি করে। এসময় তারা এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলে। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর শাহীনকে ফিন করে বিষয়টি জানায় আমানকে।